‘শাহবাগ আন্দোলনকে’ ১০ বছর পর কীভাবে দেখা হচ্ছে

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে রাজধানী ঢাকার শাহবাগে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো তার দশ বছর পূর্তি হচ্ছে রবিবার।

শাহবাগের ওই আন্দোলন নিয়ে এক দশক ধরেই রয়েছে নানা ধরনের আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্ক। এর বিরোধীরা অনেকেই একে ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা আন্দোলন’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, এর সংগঠকদের অনেকেই সেটি মানতে রাজী নন।

২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি বিকেলে প্রথমে শাহবাগে দাঁড়িয়ে যারা এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তাদেরই একজন আরিফ জেবতিক। এক দশক পর এসে তিনি মনে করেন শাহবাগ আন্দোলন শতভাগ ও পূর্ণাঙ্গ সফল একটি আন্দোলন।

“আমরা সেদিন দাঁড়িয়েছিলাম একটি মাত্র দাবিতে- তা হলো কাদের মোল্লাসহ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি এবং তাদের বিচার সংক্রান্ত আইনের সংশোধন। দেখুন- এ দুটিই আমরা অর্জন করেছি। এখানে ব্যর্থতার সুযোগই নেই। এর বাইরে যা আলোচনা সবই রাজনৈতিক, যেগুলো আমাদের বিষয় নয়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

তার মতে যুদ্ধাপরাধীদের একে একে বিচার ও শাস্তি হয়েছে এবং এটিই ছিলো ওই ‘গণজাগরণ মঞ্চের’ ব্যানারে গড়ে ওঠা ‘শাহবাগ আন্দোলনের’ একমাত্র লক্ষ্য।

যদিও জামায়াতে ইসলামীমহ বেশ কিছু ইসলামপন্থী দল শুরু থেকেই এই আন্দোলনের তীব্র সমালোচনা করে এটিকে “আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থায়নে কিংবা পরামর্শে গড়ে ওঠা আন্দোলন” হিসেবে বর্ণনা করে আসছে।

আবার কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজত ইসলামসহ শাহবাগ আন্দোলনের বিরোধীরা অনেকেই এ আন্দোলনকে ‘নাস্তিকদের আন্দোলন’ হিসেবে প্রচার করে এবং এক্ষেত্রে তারা কিছু ব্লগারের লেখনীকে সামনে এনে ব্যাপক প্রচার করে, যা শাহবাগ আন্দোলনকে যথেষ্ট বিতর্কিত করে তুলেছিলো বলে মনে করেন অনেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক রোবায়েত ফেরদৌস বলছেন শাহবাগ আন্দোলনের সফলতা কিংবা ব্যর্থতার চেয়ে বড় বিষয় হলো ওই আন্দোলন পরিষ্কার করে দেখিয়ে দিয়েছে যে সমাজে তরুণদের দুটি ধারা বিরাজমান, যার একটি শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলো আর অন্যটি ছিলো ওই বছরের মে মাসে শাপলা চত্বরে।

“শাহবাগের দাবি হয়তো অর্জিত হয়েছে, কিন্তু তরুণরা দুই ধারায় বিভক্ত। এখন তাদের মধ্যে কারা বিজয়ী হয় সেটিই হবে সামনে দেখার বিষয়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

অনেকেই মনে করেন সে সময় যুদ্ধাপরাধের বিচারে সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে শাহবাগে বড় ধরনের যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার পাল্টা হিসেবে হেফাজতের ১৩ দফার আন্দোলনকে দাঁড় করানোর একটা চেষ্টা ছিল কোন কোন মহল থেকে।

কীভাবে গড়ে ওঠেছিলো শাহবাগ আন্দোলন

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার পর একদল তরুণ তরুণী শাহবাগ মোড়ে জড়ো হয়ে তার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাতে শুরু করে, যা পরে স্বতঃস্ফূর্ত একটি আন্দোলনে রূপ নেয়।

মূলত অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের একটি দল এর সূচনা করে। পরে বিভিন্ন সংগঠন সংহতি প্রকাশ করতে শুরু করে । শাহবাগে জড়ো হতে থাকে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।

এক পর্যায়ে শাহবাগেই দিনের পর দিন অবস্থান নিয়ে একের পর এক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় এবং তাতে কার্যত সারাদেশই উত্তাল হয়ে ওঠে।

ওই আন্দোলনের মুখেই সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আইন সংশোধনের ঘোষণা দেয় এবং পরে তা কার্যকরও হয়।

এর আগে আইনে শুধুমাত্র সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির আপিলের সুযোগ ছিলো। কিন্তু আইন সংশোধনের ফলে রাষ্ট্রপক্ষ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পায়।

পরে বিচারে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হয় ও তা কার্যকরও হয়। এছাড়া ওই আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারের পর আরও কয়েকজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

আবার শাহবাগের আন্দোলন চলাকালে ব্লগার রাজীব হায়দার মারা যাওয়ার পর শাহবাগের আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা শুরু হয়।

আন্দোলন কতটা সফল – কতটা ব্যর্থ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার বলছেন শাহবাগ আন্দোলনের বড় সফলতা হলো- ৯২ সালে জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন এর মাধ্যমে সেটিরই চূড়ান্ত পরিণতি অর্জন করতে পারা।

“যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুটি আপামর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলো শাহবাগ আন্দোলন। শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক আবার সমাজের সব স্তরের মধ্যেই তারা এ আবেগ তৈরি করতে পেরেছিলো। কিন্তু রাজীব হায়দারের ঘটনার পর আন্দোলনটি একই তালে এগুতে পারেনি। কিন্তু এটিকে আবার আন্দোলনের ব্যর্থতাও বলা যাবে না,” বলছিলেন তিনি।

তবে আন্দোলনের সাথে জড়িতরা ছাড়াও বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যুদ্ধাপরাধীদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা প্রায় হয়ে গিয়েছিলো এবং তাদের অনেকে মন্ত্রীও হয়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশজুড়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা এবং তাতে সব প্রজন্মের মানুষকে সম্পৃক্ত করা যেমন আন্দোলনটির বড় সাফল্য তেমনি ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর সাথে জড়িত থাকা তরুণদের পাল্টা তৎপরতাও প্রকাশ্যে এসেছিলো যা শাপলা চত্বরের সমাবেশে প্রকাশ পেয়েছে।

তবে আন্দোলনের সময় আরও অনেক দাবির মধ্যে জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ করা কিংবা ধর্মের নামে রাজনীতি বন্ধসহ নানা দাবি ওঠে এসেছিলো যা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

আরিফ জেবতিক বলছেন আন্দোলনের মূল দাবি ছিলো একটিই – যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং সেটি কার্যকর হয়েছে।

“যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালন বন্ধ হয়েছে। তাদের শাস্তি হয়েছে। আর বাকী সব রাজনৈতিক বক্তব্য যা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা হতে পারে,” বলছিলেন তিনি।

আর রোবায়েত ফেরদৌস বলছেন শাহবাগের আন্দোলনকারীদের মূল দাবি বাস্তবায়ন হয়েছে এটি সত্যি, কিন্তু শাহবাগের বিরোধী তরুণরা যোগ দিয়েছে শাপলা চত্বরের সমাবেশে এবং তারা এদেশেরই নাগরিক।

“বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে সেটি নির্ভর করবে এই দুই পক্ষের তরুণদের কারা শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয় তার ওপর। হেফাজতের ১৩ দফা বাস্তবায়িত হলে কী হবে বা সেটি কার জয় বা পরাজয় হবে সেটিও দেখতে হবে। তবে এটি নিশ্চিত যে শাহবাগের পাল্টা প্রতিক্রিয়াই শাপলা চত্বরকে সামনে নিয়ে এসেছিলো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

CategoriesUncategorized

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *