বিদেশে থেকে সরকারের সমালোচনা করার কারণে কয়েকজন লেখক ও ব্লগারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের ক্ষোভের বিষয়টি নানা সময়ে আলোচিত হয়েছে।
এরকম কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা, তাদের আত্মীয় স্বজনদের আটক বা তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখিও হতে হয়েছে।
গত বছর একজন মন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, যারা প্রবাসে থেকে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে, তাদের পাসপোর্ট বাতিল করা হবে। যদিও সেই ঘোষণা পরে বাস্তবায়িত হয়নি।
বিভিন্ন সময় তাদের বক্তব্য সম্বলিত ভিডিও বা তথ্য ঠেকাতে সরকারের নানা ধরনের উদ্যোগের খবরও প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে।
কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ার পরেও কেন এসব সমালোচনাকে সরকার হুমকি হিসাবে দেখছে?
বিদেশে থেকে কেন সরকারের সমালোচনা
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিদেশ থেকে অনেকে সরকারের সমালোচনা করতে শুরু করেছেন।
বিশেষ করে ইউটিউব, ফেসবুক ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে এসব সমালোচনা বেড়েছে।
যারা এসব সমালোচনা করছেন, তাদের অনেকেই বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ে বা শরণার্থী হিসাবে রয়েছেন।
সমালোচকদের অভিযোগ, বাংলাদেশের সরকার নানাভাবে মতপ্রকাশে বাধা দেয়ার কারণে তারা বিদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। তারা সরকারের বিরুদ্ধে দমন পীড়নসহ নানা ধরনের অভিযোগও তুলেছেন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, দেশে মতপ্রকাশের, কথা বলার অধিকার যেহেতু সংকুচিত হয়ে গেছে, ফলে দেখা যায়, যারা অধিকার নিয়ে কাজ করেন, ভিন্নমত পোষণ করেন, সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের অনেকেই এখন দেশের বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন এবং সেখান থেকে সরকারের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের সমালোচনা-আলোচনা করছেন।‘’
‘’কারণ দেখা গেছে, দেশের ভেতরে থেকে এই ধরনের কথা বলার স্পেস ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি, এই ধরনের অধিকার কর্মীদের অনেককে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। এজন্য তারা দেশের বাইরে গিয়ে কথা বলার সুযোগটা ব্যবহার করেন,‘’ বলছেন মি. খান।
কিন্তু সবসময়েই যে এসব সমালোচনা সত্যি বা তথ্য নির্ভর হয়েছে তা নয়। অনেক সময় গুজব বা ভিত্তিহীন বক্তব্য দেয়ার অভিযোগও উঠেছে কারও কারও বিরুদ্ধে।
তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী এবং আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’এ ধরনের দাবি মোটেও সত্য নয়। যারা বিদেশে বসে এসব বলে, তারা পলিটিক্যালি মোটিভেটেড একটা ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে।‘’
‘’যেসব নাগরিক দেশের বাইরে বসে এসব করছেন, দেশে থাকার সময় তাদের কর্মকাণ্ড কি ছিল সেটা যদি আমরা খবর নেই, অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি মামলাও আছে বাংলাদেশে। তারা কোনো না কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে এখানে আইন ব্যবস্থার মুখোমুখি না হয়ে পালিয়ে আছে এবং বাইরে বসে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরকারের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে,‘’ বলছেন মি. বড়ুয়া।
সরকার যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে
বিদেশে বসে সমালোচনা বন্ধে বিভিন্ন সময় পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশের সরকার।
২০২১ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক কনক সরওয়ার বলছেন, তিনি বর্তমান সরকারের সমালোচনা করেন বলেই বাংলাদেশে তার বোনকে হেনস্থা করা হচ্ছে।
তার বোনকে আটকের পর মাদক পাওয়ার দাবি করেছিল র্যাব। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলাও করা হয়।
সেই সময় সরকারের মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, মি. সরওয়ার বিদেশে বসে অসত্য তথ্য প্রচার করছেন।
কিন্তু এ কারণে তার বোনকে বা যারা বিদেশে থেকে সরকারের সমালোচনা করে তাদের পরিবারের সদস্যদের হেনস্থা করা হচ্ছে এমন অভিযোগের জবাবে মি. রাজ্জাক বলেন, যারা বিদেশে বসে ষড়যন্ত্র করে ও দেশে থেকে তাদের যারা সহায়তা করে তাদের সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে।
“মিথ্যাচারের একটা সীমা আছে। দেশ, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এ অপশক্তিকে অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে। সাহস থাকলে দেশে এসে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হবে,” তিনি বলেন।
মি. রাজ্জাক বলেন, সরকার, সামরিক বাহিনী কিংবা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে নানা অপপ্রচার তারা চালাচ্ছে এবং একদল দেশে থেকে এসব অপপ্রচারকারীদের সহায়তা করছে বলেই আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
২০২০ সালের এপ্রিলে সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক তাসনীম খলিল সিলেটে তার মাকে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ করেছিলেন।
তখন তিনি বলেছিলেন, তার লেখালেখির কারণে বাংলাদেশে একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা তার মায়ের বাড়িতে গিয়ে তাকে ‘ভয়ভীতি প্রদর্শন’ করেছেন।
তার কয়েকদিন আগেই তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ মন্তব্য করেছিলেন, ‘দেশ-বিদেশ যেখান থেকেই হোক, গুজব ছড়ালে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে।’
তিনি বলেছিলেন, , “বিদেশে এমন বাংলাদেশি আছেন যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা গুজব সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে।”
“তারা হয়তো মনে করছেন বিদেশে আছেন বিধায় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু তারা বাংলাদেশের নাগরিক, সুতরাং বাংলাদেশের নাগরিক যেখান থেকেই অপকর্ম করুন না কেন, সরকার আইনগতভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে এবং তা করবে।”
ফ্রান্সে থাকা অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য বগুড়ায় তার বৃদ্ধ মা এবং মামাকে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ, ব্লগার আসাদ নূর তার বরগুনার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বাবা-মাসহ পরিবারের ছয় জন সদস্যকে দু’দিন আটক রাখার অভিযোগ করেছেন।
এর জের ধরে বাংলাদেশে ভিন্নমত দমন করতে অ্যাকটিভিস্ট ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানির অভিযোগ তুলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলো একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা।
ফ্রান্সে বসে সরকার বিরোধী বক্তব্য দেয়ার কারণে পিনাকী ভট্টাচার্যসহ তিনজনের বিরুদ্ধে গত বছরের অক্টোবরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে ঢাকার পুলিশ। সেই মামলায় ছাত্রদলের সাবেক এক নেতাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।
সেই মামলার অপর আসামী ছিলেন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাবেক উপ-প্রেস সচিব যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুশফিকুল ফজল, যিনি জাতিসংঘ ও মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ বিষয়ে নানা প্রশ্ন করে থাকেন।
মামলার পর ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগের উপ-কমিশনার মোঃ ফারুক হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পিনাকী ভট্টাচার্য ফ্রান্সে অবস্থান করে সরকারবিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত। তাঁর পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা পেলে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে এসে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২২ সালের সাতই জানুয়ারি জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেছেন, বাংলাদেশ-বিরোধী শক্তি দেশে- বিদেশে বসে মিথ্যা-বানোয়াট-কাল্পনিক তথ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে এবং বিদেশে উন্নয়ন সহযোগীদের ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়ক বেয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা অনেকরই সহ্য হবে না বা হচ্ছে না। দেশ-বিদেশে বসে বাংলাদেশবিরোধী শক্তি, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাই নানা ষড়যন্ত্র করছে এই অগ্রযাত্রাকে রুখে দেওয়ার জন্য।”
এরপর সেই মাসেই আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত মন্ত্রিসভা কমিটির তরফে সুপারিশ করা হয়েছিল, বিদেশে বসে যারা সরকারের সমালোচনা করছেন বা কুৎসা রটনা করছেন, তাদের পাসপোর্ট যেন বাতিল করা হয়। কিন্তু সেই সুপারিশ পরবর্তীতে কার্যকর হয়নি।
প্রবাসী সমালোচনাকে কেন হুমকি বিবেচনা করে সরকার?
বিদেশে থেকে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে যেসব সমালোচনা করা হয়, অতীতে সেসব ঠেকাতে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশের সরকার।
ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, টুইটারের মতো প্রযুক্তি মাধ্যমগুলোর ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ‘সমালোচনা’ এবং ‘মানহানিকর’ কনটেন্ট সরানোর জন্য ২০১১ সাল থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। শুধুমাত্র গুগলের কাছেই ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ১ হাজার ৫০৮টি অনুরোধ করা হয়েছে।
ধর্মীয় উস্কানি, ঘৃণা ছড়ানো, অ্যাডাল্ট কনটেন্ট, কপিরাইট, মানহানি- ইত্যাদি কারণ দেখানো হয়েছে এসব অনুরোধে।
বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বিবিসি বাংলাকে ২০১৮ সালে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ফেসবুক বা ইউটিউবের মত সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত যে কোন কনটেন্ট যদি বাংলাদেশ সরকারের কাছে দেশের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে হয়, তাহলে সরকার চাইলেই সেগুলো যাতে প্রতিরোধ করতে ব্যবস্থা নিতে পারে, সেই প্রযুক্তি আনতে সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে।
আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলছেন, ‘’অনেক ক্ষেত্রে দেখি, সাধারণত কোন সরকার যখন জনগণ থেকে ক্রমান্বয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন ছায়াকেও ভয় পায়। তখন যেকোনো ধরনের সমালোচনা- যুক্তিতর্ককে যৌক্তিকভাবে না নিয়ে, সেটাকে ভীতিকর বিবেচনা করে, নিজের ওপর হুমকি বিবেচনা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ‘’
তবে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’আমাদের সংবিধানে নাগরিকের যেসব অধিকার দেয়া হয়েছে, রাইট টু প্রাইভেসি, ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন-এগুলো আমরা সম্মান করি। আমাদের দেশের একটা রাজনৈতিক মহল, তারা দেশের বাইরে তাদের দলীয় নেতা-কর্মীদের দিয়ে একটা গুজব, অপপ্রচার, বেইজলেস ইনফরমেশন সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে দেশে একটা অস্থিরতা তৈরি করতে চায়।‘’
মি. বড়ুয়া বলছেন, বিদেশের এসব সমালোচনায় সরকার ভীত বা উদ্বিগ্ন নয়। কিন্তু মিথ্যা তথ্য দিয়ে গুজব ছড়ানো বা অপপ্রচার ছড়ানো একটি অপরাধ বলে তিনি মনে করেন।
‘’সমালোচনা এক জিনিস, তারা একটা মতামত দিতে পারে। ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের নামে কারও চরিত্র হনন করা, রাষ্ট্রের, সরকারের এবং দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো একটা অপরাধ। যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউএসএ বিভিন্ন দেশ থেকে ইন্টারনেট-বেজড বিভিন্ন চ্যানেল থেকে যে ধরনের তথ্য তারা দিচ্ছে, তা চরিত্র হনন করার মতো, বা গুজব ছড়ানো। তাদের গোপন একটা রাজনৈতিক এজেন্ডা আছে, তা হচ্ছে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা, দেশের ভেতর একটা অস্থিরতা সৃষ্টি করা,‘’ বলছেন মি. বড়ুয়া।
তিনি মনে করেন, বিদেশে বসবাস করলেও যেহেতু তারা বাংলাদেশের নাগরিক, তাই বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এ ধরনের ঘটনায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের দায়িত্বে অংশ হিসাবেই নানা পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।