শাশ্বতী ঘোষ
যখন বিনেশ ফোগতের সঙ্গে সাক্ষী মালিক আর দীনেশ পুনিয়াসহ আরও অনেকেই কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজ ভূষণ শরণ ক্যাম্পে আগত মহিলা খেলোয়াড়দের, বিশেষত অল্পবয়সী মেয়েগুলির যৌন হেনস্থা করেছে বলে অবিলম্বে তার পদত্যাগ চেয়ে দিল্লির যন্তর মন্তরে ধর্নায় বসলেন, তখন যেন আবার একবার ‘দঙ্গল’এর বাস্তবে রূপায়ণ হল। প্রথমে কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান কিছুই স্বীকার করেনি। তারপরেও ধর্না অব্যহত। ফেডারেশন প্রধানও পদত্যাগে নারাজ। ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর প্রতিবাদীদের নিজের বাড়িতে আলোচনায় ডাকলেন, সমাধান মিললো না। টালবাহানা চলছে। ধর্না চললো। অভিযুক্ত ব্রিজ শরণ বিজেপির সাংসদ বলে প্রশ্ন উঠলো প্রধানমন্ত্রীর নারীসমতা এখন কোথায়? তাঁর বিবৃতি দাবি করলো। অবশেষে প্রধানের পদত্যাগ, এইটি এবং অন্যান্য অভিযোগের তদন্তের কমিটি তৈরি হল। কমিটির মাথায় অলিম্পিকে মেডালজয়ী কুস্তিগির মেরি কম, রয়েছেন বাঙলার তীরন্দাজ দোলা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ঘটনার অনুসন্ধান, প্রতিকারের দিশা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতেও কি করে এধরণের ঘটনা বন্ধ করা যায়, তা নিয়েও কমিটি অনুসন্ধান করবে।
97541956
সাইয়ের নির্দেশিকা তো রয়েছেই প্রশ্ন হল সেই তো ২০২২ সালের জুন মাসেই, এক সাইকেলচালক প্রতিযোগী স্লোভেনিয়াতে এশিয়ান ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের প্রশিক্ষণে গিয়ে দলের প্রধান প্রশিক্ষক আর কে শর্মার হাতে বীভৎস ভাবে যৌন হেনস্থার শিকার হয়ে মেল করেন। দলের নাকি দুজন করে এক ঘরে থাকার ব্যাবস্থা হয়েছে বলে দাবি করে তিনি তাঁর ঘরে ঢুকতে চেষ্টা করেন, প্রশিক্ষণের পরে ম্যাসেজ করিয়ে দেবেন বলে জোর করে শরীরে অবাঞ্ছিত স্পর্শ করেন। সাইক্লিস্ট মেল করে ক্রীড়া দপ্তর আর ফেডারেশনকে অভিযোগ জানালে সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং পরে এই প্রশিক্ষককে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তখন স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া বা সাই বেশ কয়েকটি নির্দেশিকা জারি করে জানায় এখন থেকে প্রতিটি জাতীয় স্পোর্টস ফেডারেশন মেয়ে খেলোয়াড় দলে থাকলেই, সে দেশে হোক বা বিদেশে, একজন মহিলা কোচ থাকবেনই; প্রতিটি প্রশিক্ষণ শিবিরে, দেশে এবং বিদেশে, একজন করে নারী ও পুরুষ কমপ্লায়েন্স অফিসার থাকবেন যাঁদের দায়িত্ব হবে খেলোয়াড়দের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে জেনে নেওয়া যে দলে যৌন হেনস্থা বন্ধের নির্দেশিকাগুলি যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে কিনা এবং কোনও অভিযোগ আসলে অবিলম্বে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে তা নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে জানানো; প্রশিক্ষণ শিবির শুরু করার আগে সমস্ত খেলোয়াড়, প্রশিক্ষক আর সহায়ক সবাইকে নিয়ে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধের বিষয়ে সচেতনতার পাঠ দিতে হবে।
97526123
শুধু তাই নয়, সাই জানায় নীতিগতভাবে সমস্ত স্পোর্টস ফেডারেশন খেলোয়াড়, প্রশিক্ষক, রেফারি, কার্যকর্তা, ক্রীড়াবিজ্ঞানী এবং ক্রীড়াচিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবী, ম্যানেজার, এডমিনিস্ট্রেটর, মাবাবা বা অভিভাবক আর সংশ্লিষ্ট ফেডারেশনের প্রধান বা অফিসারদের নিয়ে খেলোয়াড়দের জন্য বৈষম্য আর যৌননিগ্রহমুক্ত নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করবে। তারপরেও কতোগুলি ফেডারেশন এই নির্দেশ মেনেছে? এরও আগে, ২০১৭ সালে খ্যাতনামা এথলিট অঞ্জু ববি জর্জ জাতীয় স্তরে খেলাধূলার মান বাড়ানোর জন্য জাতীয় স্তরে একটি নীতিমালা প্রস্তুতি কমিটির নজন সদস্যের একজন হিসাবে মেয়ে খেলোয়াড়দের শুধুমাত্র যৌন নিগ্রহে প্রতিকারের জন্য একটি ডেডিকেটেড হেল্পলাইনের কথা বলেছিলেন। সেই সুপারিশই বা কোথায় গেলো? গুরুশিষ্যের সম্বন্ধের সমস্যা খেলাধুলার জগতে, গানের, আইনের বা অন্যান্য কারুশিল্পের জগতের মতোই প্রশিক্ষক-খেলোয়াড়ের মধ্যে একটা গুরুশিষ্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যেখানে বয়স, অর্থ, প্রতিপত্তি, নারীপুরুষ প্রভৃতি ভিত্তিতে যে খেলতে আসছে এবং যিনি শেখাচ্ছেন, তাঁদের দুজনের মধ্যে একটা বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার সম্পর্ক তৈরি হয়। কোনো প্রশিক্ষক কোনো খেলোয়াড়কে ‘তৈরি’ করেন। তাই যদি কোনও প্রশিক্ষক একটি তেরো বছরের কিশোরীকে বলেন যে বাকি সবাই চারটেয় আসবে, তুমি তিনটেয় এস, তোমাকে আমি বিশেষ প্রশিক্ষণ দেবো, কারণ তোমার লঙ জাম্পে আরও ভাল করার প্রচুর সম্ভাবনা আছে, কিন্তু তারপর এই বিশেষ প্রশিক্ষণ হয়ে গেলে আবার চারটেয় এমনভাবে ঢুকবে যেন তুমি তখনই এসেছ, নাহলে বাকিরা তোমার উপরে রাগ করবে তোমাকে কেন আমি বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সেই ত্রয়োদশী কন্যা সরল বিশ্বাসে বছরের পর বছর তাই করে গেছে। এবং নিয়মিত যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছে। সে আপত্তি করলে, আটকাতে চেষ্টা করলে তাকে বলা হয়েছে সে কি ভালো করতে চায় না? ২০১৩ থেকে ২০২০। প্রশিক্ষকের কাছে আপত্তি জানালে হুমকি এসেছে, বদনাম দেওয়ার, দলে নির্বাচন না করার।
97436437
মেয়েটি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। অনেক কিছু করতে পারতো, যেমন আত্মহত্যা করেছিল এক পঞ্চদশী খেলোয়াড়। সে বুদ্ধিমতীর মতো অন্য ক্লাবে গিয়ে, উনিশ বছর বয়সে মনে জোর পেয়েছে এই প্রশিক্ষকের নামে পুলিশে যৌন হেনস্থার অভিযোগ জানাতে। দক্ষিণের বিখ্যাত প্রশিক্ষক পি নাগরাজনের বিরুদ্ধে চেন্নাই থানায় অভিযোগ দায়ের করার পর নাগরাজন ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলে, হাসপাতাল থেকে ছাড়ার পর ফৌজদারি দণ্ডবিধি আর পক্সো – দুরকম আইনেই নাগরাজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করা হয়। কারণ ইতিমধ্যে আরও সাতজন মেয়ে এক ধরণের অভিযোগ এনেছেন। এই মেয়ে অন্য ক্লাবে যোগ দেওয়ার আগের দিন নাগরাজনের মুখোমুখি হওয়ার সাহস অর্জন করেন। তাঁর সমস্ত অভিযোগের উত্তরে নাগরাজন নাকি ক্ষমা করে দিতে বলে! এরকম আরও অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে ইউরোপে খেলতে গিয়ে যৌন হেনস্থার অভিযোগ ওঠায় অনূর্ধ্ব-১৭ মেয়েদের ফুটবল দলের সহ-প্রশিক্ষক আলেক্স এম্ব্রোজকে বরখাস্ত করা হয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার দু দিনের মধ্যেই তাকে দেশে ফেরত পাঠায় অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন। তাহলে ব্রিজ ভূষণ শরনের সরতে এতো সময় লাগলো কেন? আবার ২০১১ সালে তামিলনাডু রাজ্য এমেচার বক্সিং এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি এ কে করুণাকরণ ‘দলে জায়গা পেতে গেলে সহযোগিতা করতে হবে’ বলেছেন বলে অভিযোগ দায়ের করেন ই তুলসী, যিনি ২০০৯ সালে জাতীয় সিনিয়র বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে তাম্র পদক জিতেছিলেন। হকি দলে তো যৌন হেনস্থার অভিযোগ বারবার উঠেছে। সেই ২০১০ সালে মেয়েদের হকি দলের প্রশিক্ষক, অলিম্পিকবিজয়ী মহারাজ কিষাণ কৌশিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। দায়বদ্ধতা কোথায় অভিযোগের মাত্রা ঠিক কতোটা, তা জানতে ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কতগুলি যৌন নিগ্রহের অভিযোগ সাইয়ের কাছে এসেছে, এবং সেগুলির পরিণতি ঠিক কি হয়েছে, তা জানতে একটি সংবাদপত্র রাইট টু ইনফরমেশনে আবেদন করে। তা থেকে জানা যায় এই সময়কালে ৪৫টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে, যার মধ্যে ২৯টি প্রশিক্ষকদের বিরুদ্ধে।
97121145
কিন্তু এর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই অভিযুক্তকে খুব অল্প শাস্তি দিয়ে ছাড় দেওয়া হয়েছে। পাঁচজন প্রশিক্ষকের পেনশন থেকে ১০ শতাংশ কাটা হয়েছে বা অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়েছে, একজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, দুজনের চুক্তি পুনর্নবীকরণ হয়নি। অধিকাংশ অভিযোগের বিচার শেষ হয়নি, সেগুলির আশু সমাধানের আশা কম। যেমন ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে একজন প্রশিক্ষক একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া এবং জোর করে চুমু খাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তিন বছর বাদে সাই যখন তদন্ত করে দেখল যে অভিযোগটি সত্য, ততদিনে সেই প্রশিক্ষক অবসর নিয়েছে। শাস্তি হিসাবে তার পেনশন থেকে এক বছর সামান্য টাকা কাটা হয়। স্বীকৃত ৫৬টি জাতীয় স্তরের স্পোর্টস ফেডারেশনের মধ্যে মাত্র কয়েকটিতে আভ্যন্তরীণ অভিযোগের কমিটি বা এখন যেমন বলা হয়, আভ্যন্তরীণ কমিটি রয়েছে। খেলাধূলার জগৎ কি কর্মক্ষেত্র? কেন সব স্পোর্টস ফেডারেশনকে আভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি রাখতে হবে সেই প্রশ্নে অনেকের প্রতিপ্রশ্নঃ খেলাধূলার জগৎ মানে কি আরেকটা কর্মক্ষেত্র? মেয়ে খেলোয়াড়রা বহু কারণে যৌন হেনস্থার শিকার হতে পারেন, খেলাধূলার প্রশিক্ষণে শারীরিক নৈকট্য, দীর্ঘদিন ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে প্রশিক্ষণ, এবং সমালোচনা বা বিরূপ মন্তব্য করলে দল থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা। তাই যৌন নিগ্রহ প্রতিরোধ আইন ২০১৩-এর ২(ও)(৪) ধারায় যেমন বলেছে ‘যেকোনো ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান, স্টেডিয়াম, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, বা প্রতিযোগিতা বা খেলার জায়গা, আবাসিক বা অনাবাসিক যাই হোক, তা যদি খেলা, প্রশিক্ষণ বা এই সংক্রান্ত উদ্দেশ্যে’ ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা ‘কর্মক্ষেত্র’।
76723926
অন্যদিকে ২(জি) ধারা অনুযায়ী ‘নিয়োগ কর্তা’ এবং ২(এফ) ধারা অনুযায়ী ‘নিযুক্ত’ শব্দদুটিরও এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। একজন নিয়োগকর্তা হলেন তিনি যিনি কর্মক্ষেত্রের ‘ব্যবস্থাপনা, দেখাশুনা এবং নিয়ন্ত্রণের’ দায়িত্বে থাকেন। কর্মক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ কমিটির দায়িত্বে তিনিই থাকেন। খেলাধুলার ব্যবস্থাপনার পরিপ্রেক্ষিতে ফেডারেশনগুলি এবং এই ধরণের সংস্থাগুলিই প্রতিযোগিতা, খেলাধুলা, হোস্টেল এবং ক্রীড়াগ্রামগুলির দায়িত্বে থাকে। তাই তারাই হল নিয়োগকর্তা। সেজন্য আভ্যন্তরীণ কমিটি গঠনের দায়িত্বও তাদের। মেয়ে খেলোয়াড়দের ভবিষ্যৎ গত কয়েকটি বড়ো খেলায় মেয়েরাই ভারতকে দলে উপস্থিতির আনুপাতিক হারের থেকে অনেক বেশি পদক এনে দিয়েছেন। এখন গায়ে-গতরে যেসব খেলা, দুর্ভাগ্যক্রমে দরিদ্র পরিবার থেকেই সেই সব খেলায় মেয়েরা আসেন, একটা চাকরি, একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায়। সেই মেয়েগুলির জন্য নিরাপদ আর বৈষম্যহীন পরিবেশ সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব এই ধরণের সংস্থাগুলির। তবেই হয়তো বা আমাদের ভবিষ্যতের পদকের আশা একটু উজ্জ্বল হবে। যেমন ২০২১ সালের জার্মানিতে খেলাধূলার জগতে যৌন নিগ্রহ ছিল গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী বিষয়। সেখানে ফেডেরাল পার্লামেন্টের স্পোর্টস কমিটি ২০২১ সালের মে মাসে খেলার জগতে শারীরিক, মানসিক আর যৌন নিগ্রহ নিয়ে জনশুনানির আয়োজন পর্যন্ত করে। আমরা কবে সেই গুরুত্ব দেবো?