বাঙালি কুইজিনের কথা উঠলে প্রথমেই সবার মনে পড়ে যায় মটন কষার কথা। সঙ্গে দই কাতলা, তেল কই, ইলিশের নানা জিভে জল আনা পদ তো রয়েছেই। কিন্তু সে সব ছাড়াও আম বাঙালির পাতে নিত্যদিনই এমন কিছু পদ পরিবেশিত হয়, যা স্বাদে যেমন অতুলনীয়, তেমনি স্বাস্থ্য গুণেও ভরপুর। চলুন সে সব সনাতনী বাঙালি পদের গুনাগুন সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
বাঙালি হল এমন জাত, যাঁদের জীবনে ‘জিহ্বা’র গুরুত্ব এতটাই যে হার্ট-কিডনির গুরুত্ব তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সকালের চায়ের প্রতি বাঙালির দুর্বলতার কথা ভূভারতে প্রায় সকলেরই জানা। ঠিক তেমনই নিত্য-নতুন পদ চেখে দেখার ক্ষেত্রেও এদের জুড়ি মেলা ভার। রবিবাসরীয় লাঞ্চে চাই কচি পাঁঠার ঝোল, সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা সরু চলের ভাত। শেষ পাতে চাটনি বা মিষ্টি হলে তো কথাই নেই। আর মুখরচক মাছের পদ হলে একটায় মনে ভরে নাকি! শুধু কী তাই, আম বাঙালিকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখুন, তাঁর কাছে কলকাতা মানে যতটা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, রবীন্দ্র সরোবর বা শ্যাম বাজারের নেতাজির মূর্তি, ততটাই মনের কাছে অনাদি কেবিনের মোগলাই, গোলবাড়ির কষা মাংস, মিত্র ক্যাফের কবিরাজি, নকুরের সন্দেশ আর মিষ্টি দই।
এহেন খাদ্যরসিক জাতীর জীবনের সঙ্গে নিশ্চয়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে কোলেস্টেরল, হাই প্রেশার এবং ওবেসিটির মতো সমস্যা? সেই সঙ্গে অধিকাংশ বাঙালিই নিশ্চয়ই কোনও না কোনও নন-কমিউনিকেবল রোগের শিকার? না বন্ধু, এখানেই তো টুইস্ট! আমরা যতটা রসিয়ে তেল-ঝাল-গরম মশলা দেওয়া খাবার খাই, তেমনই রোজের জীবনে এমন কিছু পদকে চেটেপুটে খাই, যা আমাদের সার্বিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকে। এই পদগুলি যেমন স্বাস্থ্যকর, তেমনিই নানা ভিটামিন-মিনারেলে সমৃদ্ধ।
১. মাছই বাঙালির লাইফলাইন
মাছ ছাড়া বাঙালির জীবন অসম্পূর্ণ। প্রতিদিনের মেনুতে আর কিছু থাকুক না থাকুক, দু’বেলা মাছ ছাড়া আমাদের চলেই না! আর এই মাছের গুণেই কিন্তু আজও আমাদের শরীর চঙ্গা রয়েছে। নানা ছোট-বড় রোগ রয়েছে দূরে। তাই শরীর বাবাজিতে সুস্থ রাখতে চাইলে কাটা পোনা হোক, কী ভেটকি। রুই হলেও চলবে, নিয়মিত মাছ খেতে ভুলবেন না যেন! আসলে মাছে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন, যা সহজেই হজম করা যায়। আর শরীরের গঠনেও প্রোটিনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মাছে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্য়াটি অ্যাসিডও। এই উপাদানটি হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। কমায় নানা ধরনের হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও। সেই সঙ্গে ব্রেন এবং চোখের টিস্যুর ভাল-মন্দের দিকেও খেয়াল রাখে। প্রসঙ্গত, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতেও মাছের কোনও বিকল্প নেই বললেই চলে!
মাছের মাথাও কিন্তু বাঙালির খুব প্রিয়। জানেন, এতে রয়েছে ভিটামিন এ এবং ডি, যা
হাড়কে শক্তপোক্ত
রাখতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। প্রসঙ্গত, সপ্তাহে এক-দু’দিন ছোট মাছ খেতেও ভুলবেন না যেন! তাতে করে শরীরে ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাসের ঘাটতি মিটবে।
২. প্রথম পাতে ‘তেতো’ চাই-ই চাই
অধিকাংশ বাঙালিই খাওয়ার শুরুতে কিছু না কিছু তেতো পদ খেতে পছন্দ করেন, তা সে করলা হোক কী নিম পাতা। আর যদি শুক্তো হয়, তাহলে তো কথাই নেই! এমন অভ্যাসই কিন্তু আমাদের সুস্বাস্থ্যের পথকে প্রশস্ত করে। কীভাবে?
করলায় রয়েছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশপাশি নানাবিধ সংক্রমণকে দূরে রাখতেও বিশেষ ভূমিকা নেয়। ফলে রোগ-ব্যাধি কাছেই ঘেঁষতে পারে না। শুধু কি তাই, সিজন চেঞ্জের সময়
সর্দি-কাশির
মতো রোগের প্রকোপ কমাতেও অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ কি হাই প্রেশার বা ডায়াবিটিস রোগে আক্রান্ত? তাহলে একবার চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করলাসেদ্ধ বা করলার রস খাওয়া শুরু করতে পারেন। উপকার পাবেন।
প্রথম পাতে নিমপাতা খেলেও উপকার মিলবে। এতে রয়েছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল প্রপাটিজ, সেই সঙ্গে আরও নানা উপকারী উপাদানেও টাসা। যে কারণে নিয়মিত নিম পাতা খেলে স্নায়ুবিক এবং হজম ক্ষমতার উন্নতি হয়। আর হজম ক্ষমতা বাড়লে যে ওজন বৃদ্ধির আশঙ্কা কমে, তা তো সবারই জানা। নিমপাতা সংক্রণের আশঙ্কাও কমায়।
৩. ডালই সুস্বাস্থ্যের চাবিকাঠি
তেতো খাওয়ার পর আমাদের ডাল চাই-ই চাই! এই পদটি নিয়মিত খেতে ভুলবেন না। কেন? কারণ, বাঙালির প্রিয় প্রায় প্রতিটি ডালেই মজুত রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, যা শরীরের নানা উপকারে লাগে। সেই সঙ্গে দেহে ফলিক অ্যাসিড এবং আয়রনের ঘাটতিও মেটায়। রক্তে শর্করার এবং খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণেও ডালে উপস্থিত ফাইবার বিশেষ ভূমিকা নেয়। অনেকক্ষণ পেট ভরিয়ে রাখতেও ফাইবারের জুড়ি মেলা ভার। তাই তো রোজের পাতে কোনও না কোনও ডাল খেলে নন-কমিউনিকেবল ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তো কমেই, সঙ্গে ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকতে বাধ্য হয়।
৪. পোস্ত খুবই গুনী
বিউলির ডাল হোক কী গরম গরম
, সঙ্গে যদি আলু পোস্ত থাকে, তাহলে তো কথাই নেই! পোস্তো সহযোগে রান্না করা যে কোনও পদই যেমন নিমেষে জিভে জল আনে, তেমনই এতে মজুত ক্যালসিয়াম হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে ঘাম ঝরায়। প্রসঙ্গত, পোস্তোতে রয়েছে প্রকৃতিক ‘কুলেন্ট’, যা স্ট্রেস কমাতেও সিদ্ধহস্ত!
৫. বেগুনই রোগমুক্তির পথ দেখাবে
প্রথম পাতে তেতো হল। তারপর ডালও পরিবেশন করা হল। আর শেষে তো মাছ রয়েছেই। কিন্তু ডালের সঙ্গে একটু ভাজা কিছু না হলে চলে! তাই তা বেগুনের নাম করতেই হয়। আট থেকে আশি, বেগুন ভাজা বা বেগুনের যে কোনও পদই সবার খুব প্রিয়। জানলে অবাক হবেন, বেগুনে উপস্থিত ডায়াটরি ফাইবার ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং রক্তে শর্করার মাত্রাকে বেঁধে রাখতে বিশেষ ভূমিকা নেয়।
হাই কোলেস্টরল এবং ক্যান্সারের মতো রোগকে দূরে রাখতে চান? নিয়মিত বেগুন খেতে ভুলবেন না। কী কারণে এই উপদেশ, তাই ভাবছেন নিশ্চয়ই? আসলে এই সবজিতে রয়েছে ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস, যা ক্যান্সার রোগকে দূরে রাখে, পাশপাশি এলডিএল (bad cholesterol) নিয়ন্ত্রণেও বিশেষ ভূমিকা নেয়। অ্যান্টি-ভাইরাল প্রপাটিজ থাকার কারণে নিয়মিত বেগুন খেলে নানা ধরনের সংক্রামক রোগ দূরে থাকতেও বাধ্য হয়। তবে তেল চপে বেগুন ভাজা খাবেন না প্লিজ! অল্প তেলে হলকা ফ্রাই করে খেতেই পারেন। তাই বুঝতেই পারছেন, রোজের ডায়েটে যদি এই বাঙালি পদগুলিকে জায়গা করে দেন, তাহলে অল্পবিস্তর শারীরিক অত্যাচারের পরেও বড় কোনও রোগ-ব্যাধি ঘারে চেপে বসার আর সুযোগ পাবে না।